সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশ বাংলাদেশে। এ ভূখণ্ডে বাঙালির সম্প্রীতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান একই বন্ধনের সহাবস্থানে বসবাস। ধর্মীয়ভাবে কেউ কারো প্রতিযোগী নয়, বরঞ্চ সহযোগী হিসেবে চলে আসছিল। উৎসব এর আনন্দ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে উদযাপন কর‍তো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। বিশেষ করে মুসলমানদের বড় ধর্মীয় আচার ঈদ এবং হিন্দুদের দুর্গাপুজা। উৎসবগুলোতে যেনে একাকার হয়ে যাওয়া। এর মাঝেই প্রবেশ করে স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক মহল। বিভেদ তৈরি করে ভাতৃপ্রতীম এই দুই ধর্মের মানুষের মাঝে। শুরু হয় সামাজিক অস্থিরতা।

এরপর সাম্প্রদায়িক হামলায় অনেক ঘটনা ইতিহাসের পাতার কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে লিখা আছে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ারই কারণ ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব। যার মূল কথা ছিল হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি একসাথে থাকতে পারেনা।

সেসময় দেশভাগ নিয়ে হিন্দু, মুসলিম আর শিখ ধর্মের মানুষেরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মেতে উঠেছিল। কলকাতা, নোয়াখালী, বিহার আর পাঞ্জাবে দাঙ্গায় ১২ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার খবরে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর ৩০ অক্টোবর থেকে হামলা শুরু হয় এবং বিরতিহীন ভাবে চলতে থাকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রায়। সমগ্র বংলাদেশ জুড়ে বিরামহীন অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মত জঘন্য নিষ্ঠুরতা চালায় মুসলিমরা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জেতার পর দেশের হিন্দু নারী-পুরুষের ওপর যে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন নেমে এসেছিল ভয়াবহ অমানবিক। বাধ্য হয়ে অনেক হিন্দু দেশ ছেড়েছিল তখন। এরপর ২০১২ সালে রামুতে হামলা, ২০১৬ সালে নাসিরনগর হামলা, ২০১৭ তে রংপুরে হামলা, ২০১৯ এ ভোলায় হামলার মতো ঘটনা ঘটে। সবশেষ ২০২১ সাল।

১৩ই অক্টোবর বুধবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিনে কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড় পূজামণ্ডপে সকালবেলা সেখানে রাখা একটি হনুমান মূর্তির হাটুর উপর ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ কুরআন রাখার খবর সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই খবরকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তৈরি হয় হৈ-হট্টগোল। কুমিল্লাসহ সারাদেশে হামলা করে ভেঙ্গে ফেলা হয় অসংখ্য মন্ডপ। অনাকাঙ্ক্ষিত সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বলে উঠে সারাদেশে। নোয়াখালী, রংপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, কক্সবাজার, সিলেটসহ ১৫ টি জেলায় ঘটে সাম্প্রদায়িক হামলার ন্যাক্কারজনক বিভৎস ঘটনা।

এই সাম্প্রদায়িক হামলায় সারাদেশে নিহত হয় ১০ জন। শত শত মন্দির, দূর্গাপূজা মণ্ডপ লুটপাট হয়, সুপরিকল্পিতভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর এবং নির্যাতন চালানো হয়।

তার আগে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া শহরে। ঘটনাটিতে নির্মাণাধীন দুর্গা প্রতিমাসহ অন্য সকল প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। কুষ্টিয়ার পর জয়পুরহাটে সহিংসতার দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে।

৮ অক্টোবর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নির্মাণাধীন অস্থায়ী পূজা মন্ডপের সবকটি প্রতিমা ভোররাতে ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। ১০ অক্টোবর চট্টগ্রামে কোতোয়ালি থানার ফিরিঙ্গবাজার এলাকায় দুর্গা প্রতিমাকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অবস্থিত ফলের আড়ৎ থেকে জাম্বুরা ছুড়ে মারা হয়, যার ফলে দুর্গা প্রতিমার একটি হাত ভেঙে যায়। প্রতিমা ভাঙচুরের আরেকটি ঘটনা ১১ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ার রাস্তামপুর গ্রামে ঘটে। একই দিনে টিপু সুলতান রোডে হামলার খবর পাওয়া গিয়েছিল। ১২ অক্টোবর, চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার করুণাময়ী কালীবাড়ির পূজা মণ্ডপে আরতি চলাকালীন একটি সাম্প্রদায়িক হামলার খবর পাওয়া যায় যেখানে অপরাধীদের মধ্যে একজন ধরা পড়ে এবং তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে দেয়া হয়। তারপরেই কুমিল্লায় নানুয়া দীঘির ঘটনা আমাদের সবার জানা। ১৩ই অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ১৮ই অক্টোবর পর্যন্ত সর্বশেষ সহিংসতার খবর পাওয়া যায়।

এসব ঘটনায় বাংলাদেশের প্রশাসন নিরাপত্তা জোরদার করার পরিবর্তে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালনের দৃশ্য দেখা যায়। সহিংসতাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন হয়না ঠিকমতো। অতীতে রামু, নাসিরনগর, ভোলা, পাবনা, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হামলা ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় একই প্রতিফলন হয়েছিল।

সারা দেশে একপক্ষ যেমন হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির ও মণ্ডপে হামলা করেছে, অগ্নিসংযোগ ও প্রতিমা ভাঙচুর করেছে, মানুষ হত্যা করেছে। তেমনি অন্য পক্ষ এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে, উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তোলে প্রতিবাদ করেছে। গণ-অনশন কর্মসূচী পালন করেছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। হাতে হাত রেখে প্রতিরোধ গড়েছে, কণ্ঠ মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যারা জড়িত তাদের বিচারের দাবি জানিয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর ছিলো ২০২১ সাল। সেইসাথে ছিলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক অবস্থান ছিল অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলাদেশের। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাস্তবায়ন ঘটাতে চেয়েছিলেন, যেখানে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার থাকবে।

২০২১ সাল শেষে আমাদের এই মাতৃভুমি ২০২২ এর নতুন আলোয় আলোকিত । স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করে ২০২২ সাল হোক মানুষের। সবরকম বিদ্বেষ বিভেদ মুছে ফেলে মানুষে মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বে সাম্যের জয়গান হোক। আগামীর বাংলাদেশ হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।