এই কথাটি সত্য সর্বদা বলা হয় যে “ইতিহাস পুনঃলিখন করা যায় না?? কিন্তু সত্য সর্বদা বিদ্যমান থাকে। কিছু সময় এটি চাপা দিয়ে রাখা গেলেও শেষ পর্যন্ত সত্যটা বেরিয়ে আসে। আমি আপনি চাই না চাই, এটাই সতত সত্য। পৃথিবীর ইতিহাসের নানা প্রান্তে,নানা সময়ে,নানা সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যার স্টিমরোলার চলেছে।

গত ১০০ বৎসরের ইতিহাসে আলোচিত হত্যা হল – ইহুদি গণহত্যা, আর্মেনিয়ান গণহত্যা,গুয়াতেমালা গণহত্যা,আফ্রিকান ইকিজা বা উবউইকানি গণহত্যা,পূর্ব তিমুর গণহত্যা,গুকুরাহুন্ডি গণহত্যা, বসনিয়ায় মুসলিম গণহত্যা,কম্বোডিয়ান গণহত্যা, ইরাকে ইয়াজিদি গণহত্যা,হুটুসের গণহত্যা, তিব্বতি গণহত্যা,মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা। কিন্তু, ১৯৭১ সালে হিন্দু গণহত্যার বিষয়টি চেপে যাওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে জাতীয়তাবাদের আড়ালে।

ইতিহাস শুধু জাতির ভদ্রস্থ ও মানবতার ইতিহাসই বলে না,সত্যকে আড়াল করার খেলাটিও খেলে। কিন্তু ইতিহাসের কাজ হল, নির্মোহ ভাবে সত্য বলা। “ম্যাট্রেস এক্সট্রুশন”, “হিউম্যান রেস জেনোসাইড” নামক “শব্দ বন্ধ”গুলো বেড়িয়ে আসে সত্য উন্মোচনের কাজটি করতে পারে??? ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর সময়, পাকিস্তানি সামরিক ও রাজাকারের সদস্যরা গণহত্যাকে জায়েজ করার জন্য একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে টার্গেট করে। টার্গেটকৃত সম্প্রদায়টি হল,হিন্দু সম্প্রদায়।

হিটলারের নাজি বাহিনী যেমন,জার্মানির শত্রু হিসাবে ইহুদিদের টার্গেট করেছিল,তেমনি পাকিস্তান সরকার,পাকিস্তানি বাহিনী ও জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের নেতা ও কর্মীরা ও টার্গেট করে সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে। তখনকার জনসংখ্যার একটি সমীকরণ যদি করেন,তাহলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার এই দেশটির মাত্র ১৩ শতাংশ ছিল হিন্দু জনসংখ্যা। এক কোটির কম ছিল হিন্দু জনসংখ্যা। কিন্তু,তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তখন ভারতে শরনার্থী হয়েছিল এক কোটির উপরে। তার শতকরা ৮০ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। অর্থাৎ প্রায় ৮০ লক্ষ। কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি হল বলেই এত বিরাট সংখ্যার হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।

তৎকালীন পাকিস্তানি অভিজাতরা বিশ্বাস করত যে বিদ্রোহের পিছনে হিন্দুরা ছিল এবং “হিন্দু সমস্যার” সমাধান হলেই বিরোধ মিটে যাবে।ঠিক যেন হিটলারের “ফাইনাল সলিউশান” ত্বত্ত্বের সফল প্রয়োগ করেছিল ঘাতকরা। পাকিস্তান রক্ষার জন্য, হিন্দুদের প্রতি সর্বোচ্চ সহিংসতা একটি কৌশলগত নীতি ছিল। পাকিস্তান সরকারের চালকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, এতে করে ভবিষ্যতের বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে।

সেই সময়ে বিরাট সংখ্যায় মোল্লারা “পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা ধর্ষণকে সমর্থন করেছিলেন এবং মহিলাদের যুদ্ধের লুণ্ঠন ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেছিলেন। যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের একটি ফতোয়া জোর দিয়েছিল যে বাঙালি হিন্দুদের কাছ থেকে নেওয়া সামগ্রী ও নারী আর শিশু “গনিমতের মাল” হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই ধর্ষণগুলির সেই সময়ের পরবর্তীতে দৃশ্যত হাজার হাজার গর্ভধারণ, যুদ্ধশিশুর জন্ম, গর্ভপাত, শিশুহত্যা, আত্মহত্যা এবং ভিকটিমদের অস্ট্র্যাসিজমের ঘটনা ঘটেছিল। যার বড় এই অংশ ছিল, হিন্দু নারীরা।

অনেকে বলতে পারেন,”বেদনার জায়গা খোঁচা দিয়ে কেন হৃদয়কে রক্তাক্ত করা?? ইতিহাস চর্চা বা বিশ্লেষণ না করলে পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে যাবে, এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রসব বেদনা।